প্রকাশিত: Tue, Jan 17, 2023 1:30 PM
আপডেট: Sun, Jun 8, 2025 3:22 AM

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বাধীনতার বিপক্ষশক্তি

গুলজার হোসেন উজ্জল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রসঙ্গে আমার অভিমত। এটা আমি বিশ্বাস করি যে, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে এতকিছু না লিখলে জাফর ইকবালের এতো হেইটার তৈরি হতো না। উনার একটা বিশেষ লেখার পর আমার মনে হয়েছে উনার হেইটার বাড়তে শুরু হইছে এবং এটা সুপরিকল্পিত। লেখাটি ছিলো, ‘তোমরা যারা শিবির কর’। জাফর ইকবাল ইমোশন ক্রিয়েট করার সক্ষমতা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উনি যে ইমোশন ক্রিয়েট করেছেন, নব্বইয়ের শেষে এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তা খোদ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। 

১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত উনি বিভিন্ন লেখায় আওয়ামী লীগকেও বিব্রত করেছেন। সিলেটের আওয়ামী নেতারা উনাকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিলেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরির লোকজন উনাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছিল। ২০০১ সালে উনি নির্বাচনের আগে লিখেছিলেন, ‘সন্ত্রাসের কারণে আওয়ামী লীগ শূন্য দিয়ে গুণ করার মতো বিরাট শূন্য পাবে’। হয়েছিলও তাই। সেসময় উনাকে সত্যদর্শী হিসেবেই সবাই আবিষ্কার করেছে। ২০০৭-২০১০ পর্যন্ত উনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমনকিছু কাজ করেছেন, যা আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আমাদের জেনারেশনের যে গণধিক্কার ও বিচার করার তীব্র মানসিকতা তাঁর একটি বড় মাইন্ড সেটআপ তৈরি করতে সাহায্য করেছেন এই জাফর ইকবাল। আমাদের শৈশবে বা কৈশোরে এটা কল্পনাতেও আসেনি। উনি অনেকক্ষেত্রেই জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। কিন্তু সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেননি। 

আমার মনে হয় নাই উনি নিজেকে বাঁচাতে এটা করেছেন। কারণ উনি অলরেডি অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েই আছেন। সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেননি। কারণ উনি মিথ্যা কথা বলবেন না। এটাও আমার ভালো লেগেছে। তবে উনি কোটা আন্দোলন নিয়ে কিছু ফালতু কথা বলেছেন। গত তের বছরে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করার মতো অনেক কিছুই ঘটেছে। কিন্তু সেসব নিয়ে কিছুই বলেননি। বললে উনার গ্রহণযোগ্যতা থাকতো। কোটা আন্দোলন নিয়ে কিছু বাজে কথা বলেছেন। যেটা শুনে আমারই ‘বমি এসেছে’। 

যাই হোক জাফর ইকবাল গত তের বছরে নিজেকে পার্টিজান বুদ্ধিজীবী হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেছেন। উনি কেন পার্টিজান লেখকে পরিণত হলেন সেই দোষ তো আমি উনাকে দিতে পারি না। না হলে ভালো হতো এতোটুকুই বলতে পারি। তবে লেখক হিসেবে উনাকে বাতিল করে দেবার বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাটা আমার কাছে হাস্যকরই মনে হয়। পাঠক মনে উনার মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারা লেখক বাংলা ভাষায় খুব কমই এসেছেন। উনাকে ট্রল করার মানসিকতাকে আমার বেশ ইন্টারেসটিংই লাগে। এটা তো অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রপাগান্ডা এবং মাস হেইটিং বাংলাদেশে খুবই কার্যকর। এ দিয়ে যে কাউকে আটকে দেওয়া যায়। ড. ইউনূসকেও অনেকে এভাবে বাতিল করে দেন। আর উনার গল্পগুলো যে বিদেশি গল্পের ছায়া বা এডাপ্টেশন সেটা উনি স্বীকার করলেই ভালো করতেন। তবে বিশ্বজুড়েই সরাসরি অনুবাদ ছাড়া এ জাতীয় এডাপ্টেশনকে অস্বীকার করারও অনেক নজির আছে। এককালে এসব ক্রেডিট কেউ দিতোও না।

ইদানীংকালে এর ব্যাপারে মানুষ সোচ্চার হয়েছে। কেবল নজরুলকে দেখেছি হাফিজের গান ভাবানুবাদ করলেও রীতিমতো ওইসব গানের আলাদা নাম দিয়েছেন ‘হাফিজ গীতি’। না দিলেও পারতেন, কারণ ওগুলো সরাসরি অনুবাদ ছিল না। বিভিন্ন পদ থেকে এক-আধটা লাইন নিয়ে একত্র করে ভাবানুবাদ করে তিনি গানগুলো বানিয়েছেন। তবুও তিনি এর নাম হাফিজ গীতিই বলেছেন। খৈয়মের রুবাই নিয়েও কিছু গান হয়েছে। কট্টর নজরুল অনুরাগীরা আবার আমি এটা বলাতেও খেপে গিয়েছিলেন। নজরুল যে হাফিজগীতি নাম দিয়েছিলেন সেই নামটিও এখন পাওয়া যায় না। আমি বলি যার যা কৃতিত্ব তাকে তা দিতে হবে। জাফর ইকবাল দোষে-গুণে মিলিয়েই। কিন্তু শিশু সাহিত্যিক হিসেবে এবং বাংলা ভাষার একজন কল্পবিজ্ঞানের লেখক হিসেবে উনি আনপ্যারালাল এই স্বীকৃতিটুকু দিতেই হবে। উনাকে নিয়ে ট্রল করার মানসিকতা ভিন্ন কিছু ইংগিত করে এবং এটা যে হবে তা বিচিত্র নয়। তিনি যেকোনো সময় কোপ খেয়ে মারাও যেতে পারেন। ইতোমধ্যে কোপ খেয়েছেনও। লেখক: চিকিৎসক